নারায়ণগঞ্জের আড়াইহাজারে সরকারদলীয় নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে এতিম খানার নামে অবৈধ পশুর হাট বসানোর অভিযোগ উঠেছে। কয়েক বছর ধরে ওই সিন্ডিকেটের লোকজন এই পশুর হাট বসিয়ে বছরে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিলেও সেই এতিমখানার কপালে জুটছে না কিছুই। পাশাপাশি রাজস্ব হারাচ্ছে সরকার, সেই সাথে ন্যায্যমূল্য থেকে বঞ্চিত হচ্ছে স্থানীয় ক্রেতারা।
স্থানীদের অভিযোগ, প্রশাসন বিষয়টি জানলেও রহস্যজনক কারণে তারা নীরবতা পালন করছেন।জানা গেছে, আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন সরকার ক্ষমতা আসার পর ২০০৯ সালে ছাত্রলীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক সাখাওয়াত হোসেন সাকু বিশনন্দী ইউনিয়ন পরিষদের পাশে স্বল্প পরিসরে দরপত্র বিহীন অবৈধভাবে একটি পশুর হাট বসান। আশে-পাশে কোন পশুর হাট না থাকায় দ্রুত সময়ের মধ্যে হাটটির পরিসর বৃদ্ধি পায়।
প্রতি বুধবারের এ পশুর হাটে পার্শ্ববর্তী জেলা ব্রাহ্মণবাড়িয়া, নরসিংদী, কুমিল্লা, সোনারগাঁওসহ বিভিন্ন এলাকা থেকে কয়েক হাজার পশু আসে। প্রতি মাসে পশু বিক্রির হাসিল বাবদ ৫ লাখ টাকার উপরে আয় হওয়ায় এই হাটের ওপর নজর পরে স্থানীয় আওয়ামী লীগের অপর একটি সিন্ডিকেটের। পরবর্তীতে উপজেলা আওয়ামী লীগ এক শীর্ষ নেতাসহ স্থানীয় আওয়ামী লীগ, যুবলীগের বেশ কয়েকজন মিলে গড়ে উঠে একটি শক্তিশালী সিন্ডিকেট। এই সিন্ডিকেট তাদের এই অবৈধ হাটকে ‘জাহির’ করতে ও সহানুভূতি পেতে টোল (হাসিল) রশিদ কাটছে স্থানীয় একটি এতিমখানার নামে। হাসিল স্লিপে লেখা থাকে ‘আল জামিয়তুলা ইসলামিয়া দারুল উলুম বিশনন্দী ও এতিমখানার এর উন্নয়ন কল্পে’। এমনকি এই হাসলির টাকার তোলার কাজে মাদ্রাসার কয়েকজন শিক্ষক শিক্ষার্থী দিনমজুর হিসেবে এখানে কাজ করতে বাধ্য হচ্ছেন বলেও অভিযোগ রয়েছে। সরকারি কোনো টেন্ডার না থাকায় সিন্ডিকেটের নির্ধারিত হাসিল দিয়েই ক্রেতাদের পশু ক্রয় কিনতে হচ্ছে এখান থেকে।
স্থানীয়রা জানান, গত কয়েক বছর ধরে এই হাটে প্রতি সপ্তাহে হাজার খানেক পশু বিক্রি হচ্ছে। ফলে আগে মাসে ৫ লাখ টাকা আয় থাকলেও এখন সপ্তাহে হাসিলের টাকার পরিমাণ দাঁড়ায় ৫ থেকে ৬ লাখ টাকা। এতিমখানায় প্রতি ঈদের সময় সামান্য নামকাওয়াস্তে টাকা দান করে পুরো বছরের প্রায় দুই কোটি টাকা ভাগ বাটোয়ারা করে নিচ্ছে আওয়ামী লীগের ওই সিন্ডিকেট।অপরদিকে এতিম খানার নামে এই অবৈধ হাট চালিয়ে নেতাদের ভাগ্য বদলালেও বদলায়নি এতিমখানার ভাগ্য।
সরেজমিনে গিয়ে দেখা গেছে, আড়াইহাজারের বিশনন্দী ইউনিয়ন পরিষদের এক কিলোমিটারে সড়কের পাশে আল জামিয়তুল ইসলামিয়া দারুল উলুম বিশনন্দী ও এতিমখানা।মাদ্রাসার সূত্র মতে, এ ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান শিক্ষার্থীর সংখ্যা ৩ শতাধিক ও শিক্ষক সংখ্যা ১৬ জন। এর মধ্যে ১০০ জন আবাসিক শিক্ষার্থী রয়েছে।এখানকার একজন শিক্ষার্থী চন্দ্রগরদী এলাকার সাকিবুল হাসান জানায়, সে পাশের বাসায় লজিং (প্রাইভেট) পড়িয়ে তার তিন বেলা খাবার জুটাতে হয়।নাম প্রকাশে এ মাদ্রাসার একজন শিক্ষক জানায়, এতিম খানার নামে পশুর হাট থেকে টাকা তুললেও ওই টাকা মাদ্রাসা পর্যন্ত পৌঁছায় না। নেতারা ভাগবাটোয়ারা করে নিয়ে যায়।
তিনি আরও বলেন, পশুর হাটের টাকায় মাদ্রাসা ও এতিমখানার ভাগ্য না বদলালেও নেতাদের ভাগ্যের পরিবর্তন হয়েছে। এত বড় লুটপাটের ঘটনা ঘটলেও নেতাদের ভয়ে কেউ মুখ খুলছে না।আল জামিয়াতুল ইসলামিয়া দারুল উলুম বিশনন্দী ও এতিমখানার অধ্যক্ষ শরীফুল ইসলাম জানান, স্থানীয় আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা অনুরোধ করে তাদের প্রতিষ্ঠানের নামে পশুর হাট থেকে টাকা তুললে উপকার হয়। হাটের দায়িত্বে যারা রয়েছে তাদের কথা রাখতে গিয়ে মাদ্রাসার ও এতিমখানা নামটি রশিদে ব্যবহার করে। মাঝে মধ্যে ফান্ডের টাকা অভাব হলে ধার নেয়া হয়।
এ ব্যাপারে বিশনন্দী বাজার কমিটির সভাপতি সাখাওয়াত হোসেন শাকু বলেন, সামাজিক ও ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের উন্নতিকল্পে এ পশুর হাটের টাকা ব্যয় করা হয়। কোনো ভাগবাটোয়ারা হয় না। বছরে দুই কোটি হোক বা ১০ কোটি হউক তা সামাজিক কাজে ব্যবহার করা হয়ে থাকে।এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, টাকা ব্যবহারের তুলনায় মাদ্রাসার উন্নতি দৃশ্যমান না হওয়ার তাদের দেখার বিষয় না।
মাদ্রাসার সভাপতি ও উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক হাজী খোরশেদ আলম সরকার বলেন, পশুর হাট আমার মাদ্রাসাও আমার, তাতে কি হয়েছে।টাকা ভাগ-বাটোয়ার বিষয়ে একাধিকবার জিজ্ঞাসা করলেও তিনি এ ব্যাপারে পরে কথা বলবেন বলে জানান।পশুর হাটটি নিয়মতান্ত্রিক নয় বলে স্বীকার করেন বিশনন্দী ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান সিরাজুল ইসলাম ভূঁইয়া। তিনি বলেন, ইউনিয়ন পরিষদের পাশে এ পশুর হাটটি বসলেও এ হাটের সঙ্গে বিশেষ করে টাকা ভাগবাটোয়ারার সঙ্গে তার কোনো সম্পর্ক নেই। তবে এ পশুর হাট বন্ধ না করে নিয়মের ভিতরে চালু করার জন্য বেশ কয়েকবার ইউএনও এসিল্যান্ডকে বলা হলেও তারা কোনো পদক্ষেপ নেয়নি। এতে সরকার বিপুল পরিমাণ রাজস্ব থেকে বঞ্চিত হচ্ছে।তবে এ অবৈধ পশুর হাটের সঙ্গে কারা কারা সম্পৃক্ত এ ব্যাপারে কোন তথ্য দিতে তিনি রাজি হননি।
উপজেলা নির্বাহী অফিসার (ইউএনও) রফিকুল ইসলাম বলেন, না, কোনো অনুমোদন নেই। যতদূর জেনেছি স্থানীয় কিছু লোকজন মাদ্রাসা বা এতিমখানার উন্নয়নের নাম করে হাট পরিচালনা করছে। হাটটি অবৈধ, তাই উচ্ছেদ করে দেওয়া হবে। আমি এসিল্যান্ড সাহেবের সঙ্গে কথা বলছি। আমরা দ্রুতই ব্যবস্থা নিব।
অবৈধ গরুর হাটের কারণে যানজট
ঢাকা বিশনন্দী আঞ্চলিক মহাসড়কে কড়ইতলা রামচন্দ্রদী বেইলি সেতুতে যানজট নিরসনে উপজেলা প্রশাসন ও গোপালদী পৌরসভার যৌথ উদ্যোগে সেতুর দুই পাশে আনসার নিয়োজিত রয়েছে। কিন্তু প্রতি বুধবার আনসার তাদের দায়িত্ব পালন করেন না। কারণ বুধবারে গরুর নেয়ার পরিবহনের এত চাপ থাকে সীমিত আনসার দিয়ে যানজট নিরসন দুঃসাধ্য হয়ে পড়ে। বিনিময়ে তাদের অতিরিক্ত পারিশ্রমিক দেয়া হয়।
আনসারদের সাথে কথা বলে জানা যায়, প্রতি বুধবার এই বেইলি সেতুর দুই পাশে বাড়তি লোক নিয়ে পশু পরিবহনের গাড়ি অতিরিক্ত পরিশ্রম করে পার করে দিতে হয়। বিনিময়ে ওই দিনের বাড়তি টাকা দাবি করা হয়। অথচ অবৈধ পশুর হাট থেকে প্রতি সপ্তাহে ব্পিুল পরিমাণ টাকা তোলা হলেও তাদের জন্য কোনো অতিরিক্ত কাজের পারিশ্রমিক দেয়া হয় না। তাই তারা বুধবার ডিউটি করেন না। এতে প্রতি বুধবার সকাল থেকে রাত অবনি কড়ইতলার পারের চালারচর পর্যন্ত রামচন্দ্রদীর এদিকে জালাকান্দি পর্যন্ত প্রায় ৬ কিলোমিটার যানজট দেখা দেয়। বুধবার হাটে যাওয়ার পরই দেখা গেছে ভয়াবহ যানজট। এ চিত্র প্রতি বুধবারের।